🌸 গল্পের নাম: “মেঘলা বিকেলের ভালোবাসা”
বাংলাদেশের এক শান্ত গ্রাম—সবুজ ধানক্ষেত, নদীর ধারে কাঁচা রাস্তা, বিকেলে পাখির ডাক। সেই গ্রামের এক সাধারণ ছেলেকে সবাই চেনে রিফাত নামে। সে কৃষকের ছেলে, কিন্তু তার স্বপ্ন অনেক বড়। রিফাতের হাতে থাকে একটা পুরনো বাঁশি—যেটা সে প্রতিদিন বিকেলে নদীর ধারে বসে বাজায়।
একদিন বিকেলে আকাশটা ছিল মেঘলা। হঠাৎ গ্রামের স্কুলের সামনে একটা প্রাইভেট কার থামল। গাড়ি থেকে নামল এক শহুরে মেয়ে—মেহরিন। কাঁধে ক্যামেরা, চোখে কালো চশমা। সে কলেজ প্রজেক্টের জন্য এসেছে গ্রামে ছবি তুলতে।
রিফাত তখন গাছতলায় বসে বাঁশি বাজাচ্ছিল। মেহরিন থেমে দাঁড়িয়ে গেল, শুনতে লাগল সেই সুর। কয়েক মুহূর্ত পর বলল,
— “তুমি বাজাচ্ছিলে?”
রিফাত হেসে বলল,
— “হ্যাঁ, সময় কাটাই সুরে।”
মেহরিন মুগ্ধ হয়ে বলল,
— “তোমার বাঁশিতে গ্রামের গন্ধ আছে, জানো?”
সেই প্রথম দেখা থেকেই শুরু হলো তাদের গল্প। মেহরিন প্রতিদিন বিকেলে গ্রামের ছবি তুলতে আসত, আর রিফাত তাকে সাহায্য করত। একদিন নদীর ধারে বসে ছবি তুলতে তুলতে মেহরিন হঠাৎ জিজ্ঞেস করল,
— “তুমি কখনও শহরে গেছ?”
রিফাত বলল,
— “না, আমি তো গ্রামের মানুষ। শহর শুধু সিনেমায় দেখি।”
মেহরিন একটু হেসে বলল,
— “তোমার মতো মানুষই আসলে শহরটাকে সুন্দর করে তুলতে পারত।”
তাদের মধ্যে ধীরে ধীরে একটা অদ্ভুত টান তৈরি হলো। মেহরিনের চোখে ছিল বিস্ময়, আর রিফাতের চোখে ছিল গভীর ভালোবাসা।
এক বিকেলে হঠাৎ প্রবল বৃষ্টি নামল। তারা দু’জন নদীর পাড়ে ভিজে গেল পুরোপুরি। রিফাত নিজের গামছা দিয়ে মেহরিনের মাথা ঢেকে দিল। মেহরিন তাকিয়ে বলল,
— “তুমি জানো, শহরে কেউ আমার জন্য এমন ভিজবে না।”
রিফাত মৃদু হেসে বলল,
— “ভালোবাসা তো বৃষ্টির মতো—যার উপর পড়ে, তারই ভিজায়।”
সেই রাতে মেহরিন বাড়ি ফিরে বুঝতে পারল, সে গ্রামের এক ছেলের প্রেমে পড়ে গেছে। কিন্তু জানত, এই ভালোবাসা শহুরে জীবনের সাথে মেলে না।
কয়েকদিন পর মেহরিনের বাবা গ্রামে এলেন। তিনি রিফাতের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বললেন,
— “আমার মেয়ের ভবিষ্যৎ শহরে, তোমার মতো গ্রামের ছেলের সাথে নয়।”
রিফাত কিছু বলল না। শুধু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। বিদায়ের সময় মেহরিন কেঁদে বলল,
— “তুমি বাঁশি বাজিয়ো, আমি শহর থেকেও শুনব।”
মেহরিন চলে গেল, গাড়ি ধুলো উড়িয়ে দূরে মিলিয়ে গেল। রিফাত নদীর ধারে বসে শেষবারের মতো বাঁশি বাজাল—বৃষ্টির সুরে, বিদায়ের সুরে।
বছর কেটে গেল। রিফাত এখনও সেই বাঁশি বাজায় প্রতিদিন বিকেলে। কেউ বলে, সে পাগল হয়ে গেছে। কিন্তু গ্রামের মানুষ জানে, সেই সুরে আজও লুকিয়ে আছে এক শহুরে মেয়ের ভালোবাসা।
অন্যদিকে শহরের এক কোণে, মেহরিন জানালার পাশে বসে কাজ করে, কিন্তু মাঝে মাঝে হাওয়ায় ভেসে আসে সেই সুর। চোখ ভিজে যায় অজান্তে।
সে ভাবে—
বছর পাঁচ কেটে গেছে। রিফাত এখনো নদীর ধারে বসে বাঁশি বাজায়। গ্রামের সবাই ভাবে সে পাগল হয়ে গেছে। কিন্তু সে জানে, তার ভালোবাসা এখনও জীবিত।
একদিন হঠাৎ গ্রামের পথে একটা গাড়ি থামল। গাড়ি থেকে নামল এক চেনা মুখ—মেহরিন। চোখে একটু ক্লান্তি, তবু সেই মিষ্টি হাসি আগের মতোই।
রিফাত হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। মেহরিন ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বলল,
— “তুমি এখনো বাঁশি বাজাও?”
রিফাতের চোখে জল চলে এলো, সে বলল,
— “তুমি তো বলেছিলে বাজাতে, তাই বাজাচ্ছি।”
মেহরিন চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। বাতাসে বাঁশির সুর ভেসে এলো—একই সেই পুরনো সুর, কিন্তু আজ তাতে মিশে আছে চোখের জল আর অপেক্ষা।
মেহরিন আস্তে বলল,
— “শহর আমাকে শান্তি দেয়নি রিফাত। সেখানে সব আছে, কিন্তু মন নেই। আমি ফিরে এসেছি, যেখানে ভালোবাসা হারাইনি।”
রিফাত বলল,
— “তুমি ফিরে এসেছ, এটাই আমার পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পাওয়া।”
বৃষ্টির ফোঁটা আবার পড়তে শুরু করল। তারা দু’জন নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে ভিজতে লাগল—যেমন সেই প্রথম দিনে।
দূরে বজ্রপাতের শব্দ, কিন্তু রিফাতের বাঁশিতে আজ অন্য সুর—
ভালোবাসার, ফিরে পাওয়ার, আর এক অনন্ত শান্তির।
